স্কাইপ ইন্টারভিউয়ের প্রস্তুতি এবং আমার অভিজ্ঞতা
স্কাইপ ইন্টার্ভিউ নিয়ে আর সবার মত আমারও অনেক ভয় ছিল। প্রফেসর কী না কী জিজ্ঞেস করে বসবেন, আর উত্তর দিতে না পারলে ইম্প্রেশন যাবে খারাপ হয়ে। তবে দিন শেষে অভিজ্ঞতা এতোটা খারাপও হয়নি। তাই সবার সাথে আমার অভিজ্ঞতাটা শেয়ার করতে ইচ্ছে হল। আরও কেউ যদি ইন্টার্ভিউয়ের মুখোমুখি হয়ে থাকেন, তাহলে আপনাদের অভিজ্ঞতাটাও শেয়ার করতে পারেন। পরবর্তীতে যারা ইন্টার্ভিউ দিবেন, তাদের অন্তত কিছুটা হলেও ধারণা হবে বিষয়টি নিয়ে।
তবে অভিজ্ঞতা শেয়ারের আগে আমি স্কাইপ ইন্টার্ভিউয়ের প্রস্তুতি সম্পর্কে কয়েকটা পয়েন্ট আলোচনা করতে চাই।
১) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টটা হল, ইম্প্রোভাইজেশন বা তাৎক্ষণিক উত্তর। অনেক প্রশ্ন সম্পর্কেই আপনার পূর্ব প্রস্তুতি থাকবে না। সেক্ষেত্রে আমতা আমতা না করে যেন চটপট উত্তরটা দিতে পারেন, সেই চেষ্টাই করতে হবে।
২) চেষ্টা করবেন প্রফেসরের রিসেন্ট পাব্লিকেশনগুলো পড়তে। সেখান থেকে পাঁচ ছয়টা প্রশ্ন রেডি রাখবেন যেগুলোর উত্তর আপনি সত্যিই জানতে ইচ্ছুক।
৩) প্রফেসরের রিসার্চের সাথে আপনার করা কোনো কাজ (গবেষণা, সার্ভে, ইন্টার্নশিপ) মিলে গেলে সেগুলো সম্পর্কে অবশ্যই বলবেন। তবে মহাভারত নয়, কী-পয়েন্ট আকারে বলুন। দেখিয়ে দিন, উনার সাথে কাজ করার ক্ষেত্রে আপনি একজন যোগ্য ক্যান্ডিডেট!
৪) অবশ্যই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় নিজের দেশ এবং মানুষের জন্য কিছু করার ইচ্ছা ব্যক্ত করবেন। উনারা এটাই চান যেন আপনি আপনার জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সবার উপকার করতে পারেন।
৫) আপনার কী কী বিষয়ের উপর কাজ করার আগ্রহ আছে, বা আপনার যদি কোনো নতুন আইডিয়া থেকে থাকে যেগুলো নিয়ে প্রফেসর এখনও কাজ করেননি, সেগুলো আপনি উনার অনুমতি সাপেক্ষে তুলে ধরতে পারেন। এ থেকে গবেষণার প্রতি আপনার আগ্রহটা ফুটে উঠবে।
এখন আসি আমার অভিজ্ঞতা বয়ানে।
স্কাইপ ইন্টার্ভিউয়ের কিছু ধরাবাঁধা প্রশ্ন আছে বলে শুনেছি। যেমনঃ তোমার সম্পর্কে কিছু বল, তোমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? কেন এই ফিল্ড বেছে নিয়েছ? কীভাবে পিএইচডিকে কাজে লাগাবে ইত্যাদি। আমিও এইসব প্রশ্নের উত্তর রেডি করে একদম নোট বানিয়ে ফেলেছিলাম। নিজে নিজে অনুশীলনও করেছি। কোনোভাবেই আমাকে আটকানোর উপায় নেই। কিন্তু বালাই ষাট! আমার চিন্তা অনুযায়ী কিছুই হয়নি।
ঠিক যেসময়টা ফিক্সড করা ছিল, সেই সময়েই প্রফেসর কল করলেন।
আমিঃ হ্যালো!
প্রফেসর (খুব মিষ্টি স্বরে): হ্যালো! আমি “ক”, প্রফেসর অফ “খ” ভার্সিটি। হাও আর ইউ?
আমিঃ আয়াম ফাইন প্রফেসর, থ্যাংক ইউ! হাও আর ইউ?
প্রঃ আ’ম ফাইন! ইজ ইট অ্যা গুড টাইম টু টক ইন স্কাইপ?
[এই সেরেছে! সারাজীবন শিক্ষকদের মর্জি অনুযায়ী সময় ঠিক করেছি। এখন একজন শিক্ষক যে আমাকে আমার মর্জির ব্যাপারে প্রশ্ন করবেন, এটা কল্পনাতীত]
আমি (খুশিতে গদগদ হয়ে): ইয়েস, অফকোর্স!
এরপর আমি ভেবেছিলাম প্রফেসর ওই গৎবাঁধা ফ্লোচার্ট অনুযায়ী জিজ্ঞেস করবেন, টেল মি সামথিং এবাউট ইওরসেলফ। আমিও ‘মাইসেলফ’ সম্পর্কে গুছানো নোট নিয়েই বসে ছিলাম। কিন্তু উনি আমার মাথা আউলিয়ে দিয়ে প্রথমেই বলে বসলেন, “আমার রিসার্চ সম্পর্কে আমি কী কী ধারণা তোমাকে দিতে পারি?”
আমি তো এই প্রশ্নের উত্তর ভেবে রাখিনি! প্রথম এক দুই সেকেন্ড মাথায় কিছু খেলল না। কিন্তু মানব মস্তিষ্ক যে চরম বিস্ময়কর একটা জিনিস, এটা আবারও প্রমাণিত হল। তিন সেকেন্ডের মাথায় আমি ঠিক করে ফেললাম, উনার বিভিন্ন রিসার্চ সম্পর্কে আমার যে প্রশ্নগুলো রেডি করা ছিল, ওগুলোই করা শুরু করব। আসলে চাপের মধ্যে পড়লে মানুষ এমন কাজও করতে পারে, যেটা সে স্বাভাবিক সময়ে ঠিক করে রাখেনি।
এভাবে ইন্টার্ভিউ শুরু হল।
আমার বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে চলে গেলো প্রফেসরের বিশ মিনিট! এক পর্যায়ে মনে হচ্ছিলো, আমিই বুঝি ইন্টার্ভিউ নিচ্ছি। যখন আমার ঠিক করে রাখা সব প্রশ্নের তালিকা শেষ হয়ে গেলো, প্রফেসর জিজ্ঞেস করলেন, “আমাদের পিএইচডি প্রোগ্রাম সম্পর্কে কোন প্রশ্ন আছে?”
আমি বোকার মত এই বিষয়েও কোনো প্রস্তুতি নিইনি। কিন্তু তারপরও “কিছু জানার নেই” বলতে পারছি না। কারণ এক জায়গায় শুনেছিলাম, এরকম বললে নাকি উনারা ধরে নেন যে আমি পর্যাপ্ত স্টাডি করিনি। স্টাডি করলে অবশ্যই প্রশ্ন থাকার কথা।
দুই তিন সেকেন্ড নীরব থাকার পর মাথায় একটা প্রশ্ন এলো (উত্তরটা ভার্সিটি ওয়েবসাইটে ছিল, কিন্তু ওই মুহূর্তে আমার মনে ছিল না), “পিএইচডি শেষ করার কোনো ধরাবাঁধা সময়সীমা আছে কিনা, যেমন চার বা পাঁচ বছর।”
এরপর প্রফেসর জানতে চাইলেন, “তোমার ক্যারিয়ার নিয়ে কী ভাবছ?”
উত্তর দিলাম, “পিএইচডি শেষে দেশে ফিরতে চাই, আমার জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে চাই।” আরও বেশ কিছু পরিকল্পনার কথা বললাম স্থূলতার গবেষণা নিয়ে। কারণ আমি সত্যিই এগুলো করতে চাই।
প্রফেসরকে বেশ সন্তুষ্ট মনে হল। উনি বললেন, “তুমি দেখা যাচ্ছে মানুষের সাথে এবং মানুষের জন্য কাজ করতে খুব পছন্দ কর?”
আমি এই পর্যায়ে হেসে ফেললাম। বললাম, “ইয়েস আই ডু ভেরি মাচ।”
এরপর প্রফেসর জিজ্ঞেস করলেন, “ভার্সিটি সম্পর্কে কোন প্রশ্ন আছে?” বললাম, “আপাতত নেই।” উনি বললেন, “আমার রিসার্চ সম্পর্কে আর কোনো প্রশ্ন?”
আমি মোক্ষম সময় বুঝে করে ফেললাম প্রশ্নটা, “আপনার ভবিষ্যৎ গবেষণা পরিকল্পনা সম্পর্কে একটু বলবেন প্লিজ?”
…
এরপর আমি আমার নিজের কিছু আইডিয়া শেয়ার করলাম। উনাকে জানালাম যে, এইসবের উপর আমি কাজ করতে আগ্রহী। ইতোমধ্যে পার হয়ে গেছে পঁয়ত্রিশ মিনিট। তারপরও প্রফেসরের ক্লান্তি নেই। উনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, “এপ্লিকেশন প্রসেস সম্পর্কে কোন প্রশ্ন আছে?”
খেয়েছে! আমি তো এই বিষয়েও কিছু ঠিক করে রাখিনি। তবে হঠাৎ মনে পড়ল, আমার SOP তে উনার নাম দিতে পারব কিনা, সেই অনুমতিটা এখন নেওয়া যায়।
এরপর প্রফেসর খুব মিষ্টি কণ্ঠে বললেন, “আর কোনো প্রশ্ন আছে তোমার?” আমি তখন প্রশ্ন করে করে দুনিয়ার সব প্রশ্ন শেষ করে ফেলেছি। বললাম, “এই মুহূর্তে আর নেই।” তখন উনি বললেন, “যদি পিএইচডি প্রোগ্রাম, আমার রিসার্চ বা এপ্লিকেশন প্রসেস সম্পর্কে তোমার কোনো প্রশ্ন থেকে থাকে, আমাকে মেইল দিয়ে জানাবে। ইট ওয়াজ নাইস টকিং টু ইউ!”
এরপর ধন্যবাদ দেওয়া, বাই বাই জানানোর মাধ্যমে শেষ হল স্কাইপ ইন্টার্ভিউ। কল ডিউরেশন তখন একচল্লিশ মিনিট!