অন-ক্যাম্পাস ইন্টার্ভিউয়ের প্রস্তুতি
অন-ক্যাম্পাস ইন্টার্ভিউ নিয়ে আমার কোনো ধারণা ছিল না। হালকা নাম শুনেছিলাম বটে, কিন্তু এটা কী এবং কেন আয়োজন করে, সে সম্পর্কে জানতাম না। এক সুন্দর দুপুরে A ভার্সিটি থেকে আমাকে ইমেইল দিয়ে জানাল, ওরা অন-ক্যাম্পাস সাক্ষাৎকার নিতে চায়, সেখানে যেতে পারব কিনা। ঐ সাক্ষাতকারে অ্যাডমিশন কমিটির শর্ট লিস্টে থাকা সবাই আসবে। ওদের সাথে আমার পরিচয়, কথাবার্তা হওয়ার একটা সুযোগ এটা। অনুষদের ফ্যাকাল্টি এবং বর্তমান গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের সাথে আলাপ করারও সুযোগ দেওয়া হবে। ক্যাম্পাস ঘুরানো হবে, সৌজন্যমূলক খাওয়া দাওয়া হবে, ইত্যাদি। এত আয়োজন দেখে আমার মাথা ঘুরে গেল। আমি কি ফাইরবো ঠিকঠাক সামাল দিতে? যা হোক, বলে দিলাম আমি যেতে খুবই আগ্রহী। এরপর ওরা বলল, আমার থাকা-খাওয়া-আসা-যাওয়া সবকিছু ওরাই কভার করবে। শুরু হল অন-ক্যাম্পাস সাক্ষাৎকার নিয়ে আমার চুলচেরা বিশ্লেষণ। অন্তরজালে যত প্রবন্ধ আছে, সব পড়ে ফেললাম। বিভিন্ন গ্রুপে পোস্ট দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কারো এরকম অভিজ্ঞতা আছে কিনা। অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী নিজেদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন। সেখান থেকে কিছু পয়েন্ট টুকে নিলাম। তারপর সবকিছু মিলিয়ে নিজের মত করে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলাম।
.
আমি যতদূর বুঝেছি, অনেক ভার্সিটি তাদের টপ লিস্টেড আবেদনকারীদের নিজ খরচে ক্যাম্পাসে নিয়ে যায়। ডিপার্টমেন্টের সাথে মুখোমুখি সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে। এরপর একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসে, ওকে অ্যাডমিশন দেওয়া হবে কিনা। অনলাইন ইন্টার্ভিউয়ের (স্কাইপ, যুম) চেয়ে এটা আমার কাছে বেশি পীড়াদায়ক লেগেছে। কেন লেগেছে, পরে বলছি। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত আবেদনকারীদের অন-ক্যাম্পাস ইন্টার্ভিউয়ের জন্য উড়িয়ে নিতে দেখেছি। সঠিক জানি না, যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে থেকে আবেদনকারীদের নিয়ে আসে কিনা।
.
প্রথমে বলে নিই আমাকে কীসের ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছিল। এতে হয়ত একটু ধারণা আসবে অন-ক্যাম্পাস সাক্ষাৎকারে কী কী পর্যায় থাকতে পারেঃ
.
১) ৮ জন প্রফেসরের সাথে সাক্ষাৎকার। তিনজন ছিলেন আমার স্টেটমেন্ট অফ পারপাসে উল্লিখিত ফ্যাকাল্টি, বাকিরা ছিলেন অ্যাডমিশন কমিটির সদস্য।
২) ক্যাম্পাস টুর
৩) বর্তমান পিএইচডি স্টুডেন্টদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ এবং খাওয়া দাওয়া
৪) নির্দিষ্ট কয়েকজন পিএইচডি স্টুডেন্টদের সাথে রাতের খাওয়া এবং কিছু প্রেজেন্টেশন দেখা
৫) একজন পিএইচডি স্টুডেন্টের থিসিস ডিফেন্স দেখা
৬) অনুষদের ভাইস চেয়ারের বাসায় রাতের খাবার খাওয়া
৭) শেষ দিন শহরের ভেতর ছোট্ট একটা টুর
.
আমি যেভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম
.
১) আমি ধরে নিয়েছিলাম, বিমানবন্দর থেকে আমাকে পিক আপ করতে এসেছে যে পিএইচডি স্টুডেন্ট, তার সাথে দেখা হওয়ার সাথে সাথেই আমার ইন্টার্ভিউ শুরু। হয়ত তাকে জিজ্ঞেস করবে আমার আচরণ কেমন ছিল, মিশতে পেরেছি কিনা ওর সাথে। তাই যতবার যতজন আমাকে পিক করতে এসেছে (হোটেল থেকে অনুষদে, অনুষদ থেকে হোটেলে, অনুষদের এক রুম থেকে আরেক রুমে), ততবার আমি স্বতঃস্ফূর্ত থাকার চেষ্টা করেছি। গল্প করার চেষ্টা করেছি। প্রোগ্রাম, লেখাপড়া, গবেষণা, জীবন – সবকিছু নিয়েই গল্প করেছি। যে আইটিনেরারি দিয়েছিল, সেখানে লেখা ছিল কোন কোন পিএইচডি স্টুডেন্টের সাথে আমার দেখা হবে। আমি ওদের প্রোফাইল সম্পর্কে ওয়েবসাইট থেকে পড়ে গিয়েছিলাম। ফলে ওদের গবেষণা, আগ্রহ ইত্যাদি নিয়ে কথা বলতে সমস্যা হয়নি।
.
২) প্রফেসরদের বেলায়ও একই কাহিনী করেছি। সবার প্রোফাইল ঘেঁটে, সবার আগ্রহ আর গবেষণা মাফিক নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্ন রেডি করে নিয়েছিলাম। প্রতিটা ইন্টার্ভিউয়ের সময় আমার হাতে ছিল প্রিন্ট করা কাগজ। সেখানে ছিল প্রফেসরের প্রোফাইল আর উনাকে যেসব প্রশ্ন করব, সেগুলো। সব প্রশ্ন তো মনে থাকে না, তাই কাগজ দেখে দেখে প্রশ্ন করেছিলাম।
.
৩) আমার লক্ষ্য কী, উদ্দেশ্য কী, সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য আমি কী কী পদক্ষেপ নিয়েছি বা নিচ্ছি, ভবিষ্যৎ গবেষণার সাথে সম্পর্কিত কোর্সওয়ার্ক করা আছে কিনা, কীভাবে অমুক অমুক বিষয়ের উপর আমার আগ্রহ জন্মাল, কীভাবে পিএইচডি ক্যারিয়ারে সফল হওয়া যায়, পিএইচডি করার জন্য কী কী দক্ষতা বা গুণ লাগে, ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর অনুশীলন করে গিয়েছিলাম।
.
৪) যে তিনজন প্রফেসরের সাথে আমার কাজ করার ইচ্ছে, উনাদের সম্পর্কে বিস্তারিত গবেষণা করে গিয়েছিলাম। আবেদন করার আগে উনাদের যেসব ইমেইল দিয়েছিলাম, স্টেটমেন্টে যা লিখেছি, সব ঝালিয়ে নিয়েছিলাম। যখন উনাদের সাথে কথা বলার সুযোগ এল, সবকিছু মিলিয়ে আড্ডা দিলাম। আমার কিছু আইডিয়া শেয়ার করলাম, উনাদের বর্তমান গবেষণা নিয়ে প্রশ্ন করলাম। মোট কথা, আগ্রহ দেখালাম।
.
৫) যারা অ্যাডমিশন কমিটির সদস্য হিসেবে আমার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন, স্বাভাবিকভাবেই সবার সাথে আমার গবেষণার আগ্রহ মিলেনি। তাই উনাদের বেলায় প্রোগ্রাম নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন করেছিলাম। সাথে এই প্রশ্ন সবাইকে করেছিলাম, “একজন পিএইচডি স্টুডেন্টের মধ্যে আপনি কোন কোন গুণ দেখতে চান?”। অ্যাডমিশন কমিটির সদস্যরা আমাকে ৪ নাম্বার পয়েন্টে উল্লিখিত প্রশ্নগুলোই ঘুরে ফিরে ধরেছিলেন। অনেকে পাব্লিকেশন নিয়ে পেঁচিয়েছেন, অনেকে রিসার্চ পেপার কীভাবে লিখতে হয় সেটা নিয়ে। আলাপ কোথা থেকে কোথায় যাবে, আগে থেকে বুঝা যায়নি। আমি স্রোতের সাথে গা ভাসিয়েছিলাম, স্মার্ট থাকার চেষ্টা করেছিলাম, তাৎক্ষণিক উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। একজন প্রফেসর বলেছিলেন, “আমি তোমাকে একাডেমিক বা পেশাগত কোনো প্রশ্ন করব না। তুমি আমাকে বল, একজন মানুষ হিসেবে তুমি কেমন। কোন জিনিসটা তোমাকে আনন্দ দেয়, কোনটা দেয় কষ্ট।” আমার কোনো প্রস্তুতি ছিল না এমন প্রশ্নের জন্য। তারপরও যথাসম্ভব উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছি।
.
৬) ডিনার বা লাঞ্চে আপনার এটিকেট দেখতে পারে। তাই খাওয়ার পাশ্চাত্য আদব কায়দাগুলো (কীভাবে ছুরি-কাঁটাচামচ ধরে, কীভাবে ন্যাপকিন কোলের উপর বিছায়, ইত্যাদি) শিখে নেওয়া ভালো। ভাইস চেয়ারের বাসায় যখন খেতে গিয়েছিলাম, তখন সেটা ছিল ইনফর্মাল পার্টি। রসিকতা, হই হুল্লোড় চলছিল। ঐ পরিবেশে আপনি কতটুকু খাপ খাইয়ে নিতে পারছেন, এটা দেখাও একটা পয়েন্ট হতে পারে। আমি মোটামুটি সবার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছি, তবে সেটা যেন জোর করে আরোপিত মনে না হয়, সেদিকেও লক্ষ্য ছিল। সবসময় মানুষ বকবক করতে পারে না। আমিও অনেক মুহূর্তে কথা বন্ধ রেখে বিশ্রাম নিয়েছি, অন্যদের কথা শুনেছি। কিন্তু সেটা যেন ‘অন্যদের এড়িয়ে চলা’ মনে না হয়।
.
৭) বর্তমান পিএইচডি স্টুডেন্টরা যেকোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে আগ্রহী থাকে। তাই যত প্রশ্ন আছে, সব ওদের করে ফেলুন। একই প্রশ্ন প্রফেসরদেরও করতে পারেন। আমি কিছু কিছু প্রশ্ন দুই পক্ষকেই করেছি। এতে ভালো ধারণা হয়েছে বিষয়টা নিয়ে।
.
৮) একজন আমাকে বলেছিলেন, উনারা পিএইচডি স্টুডেন্টের মধ্যে কোলাবোরেশন বা সহযোগিতার মনোভাব দেখতে চান। টিমওয়ার্ক ব্যাপারটা পিএইচডির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই ইন্টার্ভিউয়ের সময় উনারা আপনার সবার সাথে মিশতে পারা, কথা বলতে পারা, হাস্যোজ্জ্বল থাকা – ইত্যাদি বিষয় খেয়াল করতে পারেন।
.
৯) আপনাকে যদি কেউ পিক আপ করতে আসে, তাহলে অবশ্যই সময়মত দেখা করুন। কাউকে অপেক্ষা করিয়ে রাখবেন না।
.
১০) পোশাকের স্বাধীনতার ব্যাপারে নিশ্চিত জানি না, তবে প্রফেশনাল পোশাক পরাটাই নিরাপদ।
১১) আই২০, পাসপোর্ট, টিকেট, হোটেল রিজারভেশনের প্রিন্ট আউট ছাড়া আর কোন ডকুমেন্ট নিইনি। তবে এয়ারলাইন্সের অ্যাপ নামিয়ে নিলে প্রিন্টেড টিকেটও লাগে না। মোবাইল থেকে বোর্ডিং পাস দেখানো যায়। হোটেলেও শুধু নাম জিজ্ঞেস করে রুমের চাবি দিয়ে দিয়েছিল, রিজারভেশনের প্রিন্ট দেখাতে হয়নি। তবুও নিরাপদ থাকার জন্য ডকুমেন্ট নিয়েছিলাম।
.
ফ্যাকাল্টিরা বারবার বলেছেন, আমাদের সিভি-স্টেটমেন্ট-রিকোমেন্ডেশন লেটার উনাদের দেখা হয়ে গেছে। অন-ক্যাম্পাস ইন্টার্ভিউয়ের সময় উনারা দেখতে চান, আমরা উনাদের প্রোগ্রামের জন্য কতখানি ফিট। মানে বেস্ট ফিট কিনা। আমার কাছে মনে হয়েছে, উনারা এইসব বিষয় খেয়াল করেছেনঃ
.
১) আমি কীভাবে সবার সাথে মিশছি, নতুন কারো সাথে introduced হওয়া শুরু করে কথা চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা কেমন, সবার সাথে আমার ব্যবহার কেমন (চুপচাপ ধরনের, নাকি হাসিখুশি)। সম্ভবত উনারা আমার কোলাবোরেটিভ নেচার বুঝতে চাচ্ছিলেন।
.
২) প্রফেসরদের সাথে মিথস্ক্রিয়া কেমন ছিল, নাকি উনারাই একটানা কথা বলছেন।
.
৩) গবেষণা নিয়ে আমার মোটিভেশন কেমন পর্যায়ের, ক্যারিয়ার নিয়ে কতদূর চিন্তা করেছি।
.
ডিস্ক্লেইমারঃ লেখাটা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে বর্ণিত। অন্যদের অভিজ্ঞতা আলাদা হওয়া খুব স্বাভাবিক। তাই এই লেখাকে ধ্রুব সত্য ধরে নেবেন না, প্লিজ।