আমেরিকায় তিন মাসে আমার উপলব্ধি

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে এসেছি প্রায় তিন মাস হল। একদম নতুন একজন স্টুডেন্ট হিসেবে যেসব ঝামেলা আমাকে পোহাতে হয়েছে বা হচ্ছে, সেগুলো নিয়ে এই লেখা। সম্ভাব্য শিক্ষার্থীদের কাজে লাগবে এই আশায় লিখছি।

২০১৩ সালে পুষ্টিবিজ্ঞান থেকে মাস্টার্স শেষ করে আমি সম্পূর্ণ অন্য ফিল্ডের চাকরিতে ঢুকে গিয়েছিলাম বেতন বেশি বলে। পাঁচ বছর ওই ফিল্ডে কাজ করার সুবাদে পুষ্টি নিয়ে লেখাপড়া একদম ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিল। তবুও আমেরিকায় উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখতে আমার বাঁধেনি, নিয়মিত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। ভেবেছিলাম একবার সুযোগ পেলে লেখাপড়া করে ফাটিয়ে দেব। একদিন স্বপ্ন হল সত্যি, সুযোগ পেলাম সেন্ট লুইস বিশ্ববিদ্যালয়ে পুষ্টির উপর দ্বিতীয় মাস্টার্স করার। কিন্তু এখানে এসে কালচারাল শকের চেয়েও বেশি পেলাম একাডেমিক শক! একে তো পাঁচ বছরে মাথা থেকে অনেক জ্ঞান বেরিয়ে গেছে, তার উপর দেশের অনার্স, মাস্টার্সে যা পড়েছিলাম তারচেয়ে বহুগুণ বিস্তারিত পড়া এখানকার আন্ডার গ্র্যাজুয়েটে ছেলেমেয়েরা পড়ে ফেলেছে। ফলে মাস্টার্সে যে হায়ার লেভেলের পড়া পড়ানো হচ্ছে, সেটার সাথে খাপ খাওয়ানোটা আমার জন্য মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাকে অন্যদের চেয়ে দ্বিগুণ, তিনগুণ বেশি খাটতে হচ্ছে। এরকম কিছু হতে পারে ভেবে প্রস্তুত থাকা দরকার। আর অনার্স মাস্টার্স শেষ করার সাথে সাথে বিদেশে পড়তে চলে আসা উচিৎ। অনেকে নানা ঝামেলায় পড়ে সাথে সাথে আসতে পারেন না। সেক্ষেত্রে পড়ায় বিরতি দিয়ে পরে আবার শুরু করতে চাইলে আমার মত ঝামেলায় পড়তে হতে পারে। তাই এসব বিষয় মাথায় রাখা দরকার।

মাস্টার্স লেভেলের পড়াশোনায় হলে বসে পরীক্ষা দেওয়ার মত ব্যাপার যেমন আছে, তেমনি ক্লাস অ্যাসাইনমেন্ট (একক এবং দলগত), সেমিনার, অনলাইন কুইজ ইত্যাদির মাধ্যমেও নাম্বার উঠানোর সুযোগ আছে। দলগত কাজগুলোয় ফাঁকি দিলে (দেশে থাকতে এরকম করেছিলাম। ভাল স্টুডেন্টরা কষ্ট করেছে, আমরা গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়িয়েছি। আখেরে লাভ ওদেরই হয়েছে কারণ কাজটা শিখতে পেরেছে) আপনার লোকসান কারণ ফাইনাল প্রেজেন্টেশনে সবাইকে অংশ নিতে হয়। সবার কথা বলতে হয়, টপিক ব্যাখ্যায় অংশ নিতে হয়। এসব প্রেজেন্টেশনে সাধারণত একক এবং দলগত – দুইভাবেই নাম্বারিং হয়। তাই ফাঁকিবাজির ধান্দা দেশে রেখে আসতে হবে।

এদেশে শিক্ষকেরা যে সবসময় ক্লাসে লেকচার দেন, এমনটা নয়। অনলাইনেও আপনাকে ক্লাস করতে হতে পারে। আমাদের একজন প্রফেসর আছেন যিনি অনলাইনে লেকচার রেকর্ড করে রাখেন, আমরা নির্দিষ্ট ডেডলাইনের ভেতর সেটা শুনে নিই আর লেকচার সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন থাকলে, কিছু বুঝতে না পারলে সেটা কমেন্ট বক্সে উল্লেখ করি। উনার সাথে সামনাসামনি যে ক্লাস হয়, সেটায় উনি লেকচার সম্পর্কে আমাদের প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করেন। এমনটা হবার কারণ হল, এখানে ক্লাসের সংখ্যা বেশ কম। আমি যে তিনটা কোর্স নিয়েছি, তার মধ্যে দুটো কোর্সের ক্লাস হয় সপ্তাহে একদিন করে, আর একটা কোর্স সম্পূর্ণ অনলাইন নির্ভর। এর কারণ হল, ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্টরা শুধু পড়াশোনাই করে না, এদের কেউ গ্র্যাজুয়েট অ্যাসিস্টেন্ট, কেউ রেজিস্টার্ড ডায়েটিশিয়ান হওয়ার জন্য ইন্টার্নশিপ করছে। ফলে সবারই সময়ের টানাটানি। সবকিছু ব্যালেন্স করার জন্য মুখোমুখি ক্লাসের সংখ্যা কমিয়ে ফেলা হয়েছে। বদলে অনলাইনে লেকচার আপলোড করার সুবিধাটা নেওয়া হয় যেন সবাই সবার পছন্দমত ফ্রি টাইমে সেটা শুনতে পারে। প্রথমদিকে ফাঁকি দিয়ে বেশ ক’টা লেকচার শুনিনি। পরে দেখি লেকচার থেকে পরীক্ষায় প্রশ্ন এসেছে। কী আর করা? রসগোল্লা পেয়েছিলাম সেগুলোতে। তাই এ ধরনের অনলাইন ক্লাসের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে এবং ফাঁকি দেওয়া চলবে না।

ভাষাগত সমস্যা বেশ বড় ধাক্কা দেবে প্রথমদিকে। ওদের হড়বড় করে বলা কথা থেকে সারমর্ম বুঝতে কষ্ট হবে, আপনার ঠেকে ঠেকে বলা কথা বুঝতে সমস্যা হবে ওদের। তাই কোনোকিছু না বুঝলে আবার বলার জন্য অনুরোধ করুন, একটু ধীরে বলার জন্য অনুরোধ করুন। অনেক সময় ওরা রসিকতা করে হো হো করে হাসতে থাকে, আমি বেক্কলের মত বসে থাকি। এসব নিয়ে প্রথমে একটু খারাপ লাগলেও খারাপ লাগাটা পাত্তা না দেওয়া শেখা দরকার। উচ্চারণ আর টার্ম নিয়েও ঝামেলা হবার আশংকা প্রচুর। আমি প্রথম দিকে “টমেটো”, “লেটুস” ইত্যাদি বলতাম যেটা ওরা বুঝতই না কারণ ওরা বলে “ঠোমেইডো” আর “ল্যাডাস”। আমি ‘ক্যাপ্সিকাম’ বললে ওরা হাঁ করে তাকিয়ে থাকত কারণ এটাকে ওরা বলে ‘পিপার’।

শিক্ষকদের সাথে যোগাযোগ করাটা সব শিক্ষকই অ্যাপ্রিশিয়েট করেন। কোনোকিছু না বুঝলে যদি আপনি শিক্ষককে জিজ্ঞেস করেন, ইমেইল করেন, উনার সাথে দেখা করে পড়াশোনার ব্যাপারে কথা বলেন, এসব আপনার সম্পর্কে ভাল ইম্প্রেশন তৈরি করে। যেহেতু ডিপার্টমেন্ট আপনাকে স্টাইপেন্ড দিয়ে নিয়ে এসেছে (অ্যাসিস্টেন্টশিপ পাওয়া স্টুডেন্টদের কথা বলছি), তাই আপনার প্রো-অ্যাক্টিভ থাকাটা জরুরি। এতে ডিপার্টমেন্ট বুঝতে পারে যে আপনাকে সুযোগ দিয়ে তারা সঠিক কাজ করেছে। আপনি শিখতে ইচ্ছুক, লেখাপড়ার প্রতি যত্নশীল।

এগুলো আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। অন্যদের অভিজ্ঞতা একরকম নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে judgmental না হওয়ার জন্য অনুরোধ করছি।

আজ এ পর্যন্তই। ভাল থাকুন, সবার জন্য শুভ কামনা!

মন্তব্য

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।