আমেরিকায় প্রথম সেমিস্টারের অভিজ্ঞতা

উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে কীভাবে আসা যায় সেটা নিয়ে অনেক পোস্ট লেখা হয়, তাই ওদিকে যাচ্ছি না। আমি লিখতে চাই আমার প্রথম সেমিস্টারের অভিজ্ঞতার কথা। এমন অনেকে আছেন যারা আমেরিকায় আসতে চান কিন্তু এখানকার পড়াশোনার ধরন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাচ্ছেন না। আশা করি তাদের কিছুটা হলেও সাহায্য করবে এই পোস্ট।

আমার মাস্টার্সের প্রথম সেমিস্টার শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালের আগস্ট মাসের ২৭ তারিখ থেকে, শেষ হয়েছে ডিসেম্বরের ১৩ তারিখে। আগস্ট থেকে শুরু হওয়া সেমিস্টার “ফল সেমিস্টার” হিসেবে পরিচিত। বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটা সেমিস্টার দেখা যায় – ফল, স্প্রিং (জানুয়ারি থেকে মে’র মাঝামাঝি), সামার (মে/জুন থেকে জুলাই/আগস্টের মাঝামাঝি)। ফলে তিন ক্রেডিটের তিনটা কোর্স নিয়েছিলাম, মোট নয় ক্রেডিটের সেমিস্টার। প্রতি কোর্সের জন্য সপ্তাহে তিন ঘণ্টা করে ক্লাস, তিনটা কোর্সের জন্য নয় ঘণ্টা।

সেমিস্টারের প্রথম ক্লাসে প্রতিটা কোর্স ইন্সট্রাক্টর তাদের সিলেবাস দিয়ে দিয়েছিলেন। কবে কবে ক্লাস হবে, কোন ক্লাসে কী টপিক পড়ানো হবে, কোন কোন বই অনুসরণ করতে হবে, কবে পরীক্ষা, কবে কোন অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে হবে, কীভাবে মার্ক ডিস্ট্রিবিউশন হবে – সবকিছু উল্লেখ করা ছিল। কোনো পরীক্ষা বা অ্যাসাইনমেন্টে কম নাম্বার চলে এলে সেটা কীভাবে পুষিয়ে নেওয়া যায়, সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় সিলেবাস থেকে। যেহেতু আপনার ফাইনাল গ্রেড হবে কিউমুলেটিভ বা সম্মিলিত, তাই একটা পরীক্ষায় খারাপ করলে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। পরের পরীক্ষাগুলোয় ভাল নাম্বার উঠালে গ্রেড ভাল চলে আসবে।

ক্লাস কীভাবে নেওয়া হত, সে বিষয়ে একটু ধারণা দিই। এখানকার ক্লাসগুলো ক্লাসরুমেও নেওয়া হতে পারে, অনলাইনেও নেওয়া হতে পারে। আবার দুটো মাধ্যম মিলিয়েও ক্লাস নেওয়া হয়। আমার দুটো কোর্স ছিল ক্লাসরুম + অনলাইন নির্ভর। অনলাইনের ক্লাসগুলো কেমন? প্রতি সপ্তাহে শিক্ষকেরা মেইন লেকচার রেকর্ড করে ভার্সিটির নির্দিষ্ট সাইটে আপলোড করেন। ওই সাইটে কারো এক্সেস থাকলে লেকচারটা শোনা যাবে। আমাদের ভার্সিটি ব্যবহার করে McGraw-Hill Education কোম্পানির তৈরি Tegrity সফটওয়ার। তাই এই লেকচার স্টুডেন্টদের কাছে “টেগ্রিটি লেকচার” নামে পরিচিত। যেদিন ক্লাসরুমে আসতে হবে, তার কয়েকদিন আগে অনলাইন লেকচার আপলোড করা হয়। আপনি সেই লেকচার শুনবেন এবং শুনে মনে প্রশ্ন জাগলে ক্লাসে গিয়ে প্রফেসরকে জিজ্ঞেস করবেন। অর্থাৎ প্রফেসররা ক্লাসকে ব্যবহার করতেন সমস্যা সমাধানের সুযোগ হিসেবে। আবার এই লেকচারের উপর ভিত্তি করেই প্রফেসররা প্রতি সপ্তাহে কুইজ দিতেন যেগুলো ছিল অনলাইন নির্ভর। আপনি বাসায় বসে প্রফেসরের লেকচার, অনলাইন রিসোর্স কিংবা বই ঘাঁটাঘাঁটি করে কুইজের উত্তর দিতে পারবেন। বাসায় বসে যেসব পরীক্ষা দেওয়া যায় সেগুলোকে “টেক হোম” একজাম বলে। শুনতে সহজ মনে হলেও প্রস্তুতি না থাকলে টেক হোম বেশ কঠিন। নির্দিষ্ট সময়ের ভেতর জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে উত্তর বের করতে গিয়ে ভুল হওয়া বা সময় শেষ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই প্রস্তুতি নিয়েই পরীক্ষায় বসতে হয়।

ক্লাসরুম অডিটোরিয়াম সিস্টেমের হতে পারে, কিংবা সাধারণ। যে সিস্টেমেরই হোক না কেন, প্রতিটা ক্লাসরুমে প্রজেক্টর আছে। সাধারণ ক্লাসরুমের যে ব্যাপারটা আমাকে মুগ্ধ করেছে সেটা হল, পিছন দিকে যারা বসে, তাদের জন্য দেওয়ালে টিভি স্ক্রিন লাগানো থাকে যেন পোডিয়ামে যিনি আছেন, তাকে দেখা যায় এবং তার কথা শোনা যায়। ক্লাসে বসে আপনি খেতে পারবেন তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন অন্যের অসুবিধা না হয় (কুড়মুড়ে খাবার খেলে কুড়মুড়ানির শব্দে অন্যরা বিরক্ত হতে পারে)। আমি এমনও ক্লাসমেট পেয়েছি যারা এক চেয়ারে বসে আরেক চেয়ারে দুই পা তুলে চেগিয়ে চেগিয়ে ক্লাস করেছে, কিন্তু প্রফেসর তাতে অফেন্ডেড হননি।

তৃতীয় কোর্সটা ছিল পুরোপুরি অনলাইন নির্ভর, অর্থাৎ ইন্সট্রাক্টর ক্লাসরুমে আসতেন না। যদি কেউ কোর্স নিয়ে কোনো প্রকার সমস্যা অনুভব করে, তাহলে প্রফেসরের এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে তার সাথে দেখা করা যেত।

বিভিন্ন প্রফেসর বিভিন্নভাবে স্টুডেন্টদের পরীক্ষা করে থাকেন। দেশে যেমন বছরে তিনটা পরীক্ষার একটা সিস্টেম পেয়েছি (দুটো মিডটার্ম, একটা ফাইনাল), এখানে এমন কিছু নেই। তিন কোর্সের তিন শিক্ষক তিনভাবে তাদের কোর্স সাজিয়েছেন। যেমন, প্রথম কোর্সের শিক্ষক তিনমাসের ভেতর তিনটা Hall test নিয়েছেন, দ্বিতীয় প্রফেসর নিয়েছেন দুটো “টেক হোম” পরীক্ষা (একটা মিডটার্ম, একটা ফাইনাল), আর তৃতীয় প্রফেসর কোনো পরীক্ষাই নেননি। তিনি বিভিন্ন অ্যাসাইনমেন্টের উপর ভিত্তি করে ফাইনাল গ্রেড দিয়েছেন।

পরীক্ষা শুধু লেকচারের উপর ভিত্তি করে হত না। শিক্ষকেরা লেকচারের পাশাপাশি অনলাইনে অনেক সহায়ক উপাদান আপলোড করতেন। হতে পারে সেগুলো বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ, পাওয়ার পয়েন্ট, মডিউল কিংবা ভিডিও লিংক। মোট কথা, উনারা যেসব সোর্স আপনার সাথে শেয়ার করেছেন, সেগুলোর যে কোনোটা থেকেই পরীক্ষায় প্রশ্ন আসতে পারে। আমি প্রথম পরীক্ষায় শুধু লেকচার পড়ে গিয়েছিলাম বলে ‘এফ’ গ্রেড এসেছিল। পরের পরীক্ষাগুলোয় ঠিকমত প্রস্তুতি নিয়ে ফাইনাল গ্রেড ‘বি+’ তোলা সম্ভব হয়েছে।

পরীক্ষায় প্রফেসরের লেকচার বা পাঠ্যপুস্তক থেকেই যে উত্তর লিখতে হবে, এমনটা নয়। পিয়ার রিভিউড গবেষণা থেকে তথ্য নিয়েও উত্তর লেখা যাবে। তবে ঠিকভাবে উৎসের উল্লেখ করতে হবে যেন প্রফেসর যাচাই করতে পারেন। আবার গবেষণা যেহেতু প্রতিনিয়ত আপডেটেড হচ্ছে, তাই সাম্প্রতিককালের সায়েন্টিফিক আর্টিকেল থেকে পাওয়া তথ্যই উল্লেখ করা উচিৎ। এখানে একটা ঘটনা বলা যায়। আমার কিছু ক্লাসমেট আছে যারা সাম্প্রতিক গবেষণা নিয়ে প্রচুর ঘাঁটাঘাঁটি করে। তারা জানত, সম্প্রতি একটা গবেষণার মাধ্যমে একটা প্রতিষ্ঠিত সত্যের বিপরীতে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। পরীক্ষায় ওই প্রতিষ্ঠিত সত্যের উপর ভিত্তি করে একটা প্রশ্ন এসেছিল। তারা উত্তরে প্রতিষ্ঠিত সত্যের পাশাপাশি সাম্প্রতিক গবেষণার কথা উল্লেখ করে ফুল মার্ক পেয়েছিল।

এবার আসি অ্যাসাইনমেন্টের ধরনে। তিনজন প্রফেসরের অ্যাসাইনমেন্টের ধরন আলাদা হবে, এটাই স্বাভাবিক। যিনি শুধু অনলাইনে ক্লাস নিতেন, তার অ্যাসাইনমেন্ট ছিল অনলাইন নির্ভর। বাকি দুজন প্রফেসরের একজন আমাদের দিয়ে টক শো করিয়েছেন, নির্দিষ্ট টপিকের উপর ভিডিও বানাতে দিয়েছেন, সেমিনার করিয়েছেন। আরেকজন নির্দিষ্ট সাইটে গিয়ে রোগীদের কাউন্সেলিং করতে দিয়েছেন, বই রিভিউ করতে দিয়েছেন, নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে পুষ্টিশিক্ষা দিয়েছেন। মোট কথা, যেভাবে স্টুডেন্টদের সবচেয়ে বেশি উপকার হবে, কোর্সের বিষয়বস্তুর সাথে যেভাবে স্টুডেন্টরা একাত্ম হবে, সেভাবেই ইন্সট্রাক্টররা তাদের মেথড সাজিয়েছেন।

আজ এ পর্যন্তই, ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন।

মন্তব্য

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।